গ্যালারি

আল্লাহর পথে দাওয়াত – সুন্নাতের আলোকে দাওয়াত: ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর – ৫

ইবাদত পালনে সুন্নাতের গুরুত্ব:সুন্নাতের অর্থ ও পরিচয়

সুন্নাত শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো: মুখ, ছবি, প্রতিচ্ছবি, প্রকৃতি, জীবন-পদ্ধতি, কর্মধারা ইত্যাদি।

সাধারণভাবে সুন্নাত বলতে আমরা বুঝি ফরজ ও ওয়াজিবের পরবর্তী পর্যায়ের নেককর্ম যা করা অত্যাবশ্যকীয় নয়, তবে উচিত, উত্তম ও প্রয়োজনীয়। তবে হাদিস শরিফে এবং সাহাবি তাবেয়ীনগণের পরিভাষায় সুন্নাত বলতে বুঝানো হয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সকল প্রকারের নির্দেশ, কথা, কর্ম, অনুমোদন বা এক কথায় তাঁর সামগ্রিক জীবনার্দশ। এ ছাড়া তাঁর সাহাবিদের কর্ম ও আদর্শও এই অর্থে সুন্নাত বলে অভিহিত হয়।

সুন্নাতের অর্থ ও পরিচয় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করেছি এহইয়াউস সুনান গ্রন্থে। এ পুস্তিকার সংক্ষিপ্ত পরিসরে আমরা বলতে পারি যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সামগ্রিক জীবন পদ্ধতিই সুন্নাত। যে কাজ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেভাবে করেছেন তা সেভাবেই করা তাঁর সুন্নাত। যা তিনি করেননি, অর্থাৎ বর্জন করেছেন তা না করা বা বর্জন করাই সুন্নাত। কোনো কর্ম পালন বা বর্জনের ক্ষেত্রে গুরুত্ব, পদ্ধতি, ক্ষেত্র, সময়, স্থান ইত্যাদি যে কোনো বিষয়ে সুন্নাতের বেশি বা কম হলে বা সুন্নাতের বাইরে গেলে তা খেলাফে সুন্নাত হবে। তিনি যা করেননি বা খেলাফে সুন্নাত, কর্ম কখনোই দ্বীনের অংশ বা ইবাদতের অংশ হতে পারে না। তবে জাগতিক কর্ম হিসাবে বা ইবাদতের উপকরণ হিসাবে শরিয়তের বিধানের আলোকে তা জায়েয বা নাজায়েয হতে পারে।

সুন্নাতের বাইরে কোনো ইবাদত কবুল হবে না

কোরআন-হাদিসের অগণিত নির্দেশনা থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, আল্লাহর দরবারে যে কোনো ইবাদত কবুল হওয়ার অন্যতম শর্ত হলো যে, সেই ইবাদতটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাত বা রীতি অনুসারে পালিত হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে কেবলমাত্র ইবাদতের নির্দেশই দেননি, উপরন্তু প্রতিটি ইবাদত নিজে পালন করে ইবাদতটি পালনের বিশুদ্ধ পদ্ধতিও তিনি আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন। প্রতিটি ইবাদত তাঁর পদ্ধতি বা সুন্নাত অনুসারে আদায় করা অত্যাবশ্যকীয়। সুন্নাতের ব্যতিক্রম কোনো কর্ম বা পদ্ধতি আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য নয়। কোনো ইবাদত যদি তাঁর পদ্ধতির বাইরে কোনোভাবে পালিত হয় তাহলে তো আল্লাহর নিকট কবুল হবে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

আমাদের কর্ম যা নয় এমন কোনো কর্ম যদি কোনো মানুষ করে তাহলে তার কর্ম প্রত্যাখ্যাত হবে (কবুল হবে না)। (বুখারি ও মুসলিম)।

অন্য হাদিসে তিনি বলেন,

যে ব্যক্তি আমার সুন্নাত থেকে অন্যমনস্ক হলো বা আমার সুন্নাতকে অপছন্দ করলো তার সাথে আমার সম্পর্ক নেই। (বুখারি ও মুসলিম)।

দাওয়াতের কাজও সুন্নাত পদ্ধতিতে হতে হবে

তাহলে আমরা বুঝতে পারি যে, দাওয়াত, তাবলিগ বা দীন প্রতিষ্ঠার ইবাদত পালন করতে আমাদেরকে হুবহু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অনুসরণ করতে হবে। দাওয়াত বা দীন প্রতিষ্ঠার ইবাদতও যদি তাঁর সুন্নাত বা পদ্ধতির বাইরে পালিত হয় তাহলে তা প্রত্যাখ্যাত হবে এবং কবুল হবে না।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, তাহলে কি আমাদের সে যুগের মত উটের পিঠে চড়ে দাওয়াতের জন্য চলাচল করতে হবে? আমরা কি মটরগাড়ী, এরোপ্লেন ইত্যাদিতে দাওয়াতের জন্য চলাচল করতে পারব না? আমরা শুধু মুখে বা হাতে লিখেই দাওয়াতের কাজ করব? আমরা কি আধুনিক মুদ্রণ, মাইক, রেডিও ইত্যাদি ইলেকট্রিক বা ইলেকট্রনিক উপকরণাদি ব্যবহার করতে পারব না? তিনি দাওয়াতের জন্য কোনো কারিকোলাম, সিলেবাস, সুনির্দিষ্ট বই পুস্তক, কর্মসূচি, সময়, দিন, মাস, বৎসর, স্থান বা অন্য কোনো বিষয় নির্ধারণ করে দেননি। তাহলে কি আমরা দিন, সময় বা স্থান নির্ধারণ করে বা বই পুস্তক ইত্যাদি নির্ধারণ করে দাওয়াতের জন্য কোনো কারিকোলাম বা কর্মসূচী গ্রহণ করব না?

ইবাদত ও উপকরণের পার্থক্য

বিষয়গুলি বুঝার জন্য আমাদেরকে ইবাদত ও ইবাদতের উপকরণের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে হবে। আমি এহইয়াউস সুনান গ্রন্থের চতুর্থ ও পঞ্চম অধ্যায়ে এ বিষয়ে যথাসাধ্য বিস্তারিত আলোচনার চেষ্টা করেছি। দাওয়াতে রত মুমিনকে আমি সবিনয়ে আনুরোধ করব বইটি পড়ার জন্য। এখানে আমরা সংক্ষেপে বলতে পারি যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা করেননি বা নির্ধারণ করেননি তা কখনোই দ্বীনের আংশ বা সাওয়াবের উৎস নয়। তবে তা ইবাদত পালনের উপকরণ হতে পারে।
ইবাদত পালনের ক্ষত্রে তিনি যে সকল উপকরণ বা পদ্ধতি ব্যবহার করেননি তা দু প্রকারের। প্রথম প্রকারের উপকরণ তাঁর যুগে বিদ্যমান ছিল বা সে যুগে তার জন্য সেগুলি ব্যবহার করা সম্ভব ছিল, কিন্তু তিনি তা ব্যবহার করেননি। এগুলি মুমিন ব্যবহার করেন না; কারণ তিনি উচ্ছাপূর্বক তা বর্জন করেছেন। অন্য প্রকারের উপকরণ যেগুলি তাঁর যুগে ছিল না, পরবর্তীযুগে উদ্ভাবিত হয়েছে। ইসলামের অন্যান্য বিধিবিধানের আলোকে মুমিন ইবাদত পালনের উপকরণ হিসাবে প্রয়োজনে এ ধরণের উপকরণ ব্যবহার করতে পারেন। কিন্তু কখনই এর ব্যবহারকে ইবাদত বা ইবাদতের অংশ বলে মনে করতে পারেন না। সাওয়াব নির্ভর করবে মূল ইবাদত পালনের বিশুদ্ধতা, ব্যপকতা ও গভীরতার উপরে। এ সকল উপকরণের সাথে সাওয়াবের সামান্যতম সম্পর্ক থাকবে না।

দাওয়াত বা দীন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পদ্ধতি ও উপকরণের সুন্নাত ও খেলাফে সুন্নাত এবং এ বিষয়ক কিছু ভুলভ্রান্তি এখানে আলোচনা করতে চাই।

দাওয়াতের মাসনুন পদ্ধতি ও উপকরণ

আদেশ, নিষেধ, দীন প্রতিষ্ঠা বা দাওয়াতের যে সকল উপকরণ ও পদ্ধতি কোরআন-হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যবহার করেছেন সে সকল মাসনুন বা সুন্নাত সম্মত উপকরণের অন্যতম হল ১. কোরআন ২. হাদিস, ৩. হিকমাহ বা প্রজ্ঞা, ৪. সুন্দর ওয়াজ-উপদেশ, ৫. উৎকৃষ্টতর পদ্ধতিতে আলোচনা-বিতর্ক, ৬. জিহাদ ও কিতাল, ৭. অনুকরণীয় আদর্শ প্রতিষ্ঠা, ৮. উৎসাহ, পুরুস্কার ও শাস্তি।

  • কোরআন মাজিদ
    কুরআনুল কারীম ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দাওয়াতের প্রধান ও মূল উপকরণ। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা কোরআন কারীমে তাঁকে কোরআন পাঠ করে দাওয়াত প্রদানের নির্দেশ দিয়েছেন। কাফিরগণকে দ্বীনের দাওয়াত দিতে এবং মুমিনগণকে দ্বীনের দাওয়াত দিতে উভয় ক্ষেত্রে তিনি নিজে সদা সর্বদা কোরআন পাঠ করে দাওয়াত প্রদানকেই সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করতেন।
  • হিকমাহ ও হাদিস
    কোরআন কারীমে বারংবার বলা হয়েছে যে, মহান আল্লাহ তাঁর মহান রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কুরআনের পাশাপাশি হিকমত বা প্রজ্ঞা দান করেছেন এবং তিনি তাঁর উম্মতকে কোরআনের পাশাপাশি প্রজ্ঞার মাধ্যমে দাওয়াত ও দ্বীন প্রতিষ্ঠা করেন।
    (বাকারা : ১২৯, ১৫১, ২৩১, ২৫১, আলে ইমরান: ১৬৪, নিসা : ১১৩, আহযাব : ৩৪, জুমুআহ : ২)
    রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রদত্ত হিকমত বা প্রজ্ঞা বা তাঁর আজীবনের শিক্ষা হাদিস হিসেবে সংকলিত ও সংরক্ষিত হয়েছে।
  • সুন্দর ওয়াজ
    সুন্দর ওয়াজ ছিল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দাওয়াতের অন্যতম উপকরণ। কোরআনে তাঁকে ওয়াজের মাধ্যমে দাওয়াত দেওয়ার জন্য বারংবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। (সূরা নিসা : ৪, সূরা নাহল : ১২৫)।
    কোরআনকেও বারংবার ওয়াজ হিসাবে অভিহিত করা হয়েছে (সূরা বাকারা : ২৭৫, সূরা ইউনুস : ৫৭)।
    রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওয়াজের ক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে, তাঁর ওয়াজ ছিল মূলত: কোরআন নির্ভর। বিভিন্ন হাদিস থেকে আমরা দেখতে পাই যে, তিনি বক্তৃতা, ওয়াজ, খুতবা ইত্যাদি সব কিছুতেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোরআন পাঠ করতেন। এগুলির পাশাপাশি কিছু হিকমাহ বা উপদেশ প্রদান করতেন যা হাদিসরূপে সংকলিত। তাঁর ওয়াজের ক্ষেত্রে স্পষ্টতা, আন্তরিকতা, কৃত্রিমতাহীন, সরলতা, সংক্ষেপন ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়।
  • উৎকৃষ্টতর পদ্ধতিতে আলোচনা বিতর্ক
    উৎকৃষ্টতর পদ্ধতিতে আলোচনা বিতর্ক উপস্থাপনের ক্ষেত্রে কোরআন অনন্য গ্রন্থ। ইহুদি, খৃস্টান, পৌত্তলিক বিভিন্ন অবিশ্বাসী সম্প্রদায়ের বিশ্বাস, কর্ম, আচার ইত্যাদির অসারতা, ভিত্তিহীনতা এবং ইসলামি বিশ্বাস ও কর্মের যৌক্তিকতা, প্রয়োজনীয়তা ও কল্যাণ অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী, সরল ও আকার্ষণীয়ভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এক্ষেত্রে মূলনীতিই হলো প্রতিপক্ষের পদ্ধতির চেয়ে দায়ীর পদ্ধতি উৎকৃষ্টতর হতে হবে। ভাষা, ভাব, বিনম্রতা, বন্ধুভাবাপন্নতা, আন্তরিকতা, উপস্থাপনা সকল দিক থেকেই তা হবে উৎকৃষ্টতর। প্রতিপক্ষের সম্মান প্রদান, তার ভাল গুণাবলীর প্রশংসা, ব্যক্তিগত আক্রমণ বর্জন, ঢালাও অভিযোগ বর্জন ইত্যাদি কোরআনী বিতর্ক আলোচনার বৈশিষ্ট্য। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আজীবন এই পদ্ধতির অনুসরণ করেছেন।
  • জিহাদ ও কিতাল
    দাওয়াতের একটি কোরআন-সুন্নাহ নির্দেশিত পদ্ধতি ও উপকরণ হলো জিহাদ ও কিতাল। জিহাদ অর্থ শ্রম, কষ্ট, চেষ্টা ইত্যাদি। কিতাল অর্থ যুদ্ধ। তবে ইসলামি পরিভাষায় সাধারণভাবে জিহাদ বলতে কিতাল বা যুদ্ধ বুঝানো হয়। এছাড়া দাওয়াতের কর্মকেও জিহাদ ও সর্বত্তোম জিহাদ বলা হয়েছে।
    কোরআন হাদিস থেকে আমরা জানতে পারি যে, কিতাল বা যুদ্ধ রাষ্ট্রীয় ফরজ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যম ছিল দাওয়াত। জিহাদ-কিতাল রাষ্ট্রের সংরক্ষণ ও নিরাপত্তার মাধ্যম। দাওয়াতের মাধ্যমে মদিনায় ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আগে আল্লাহ যুদ্ধ পর্যায়ের জিহাদ বৈধ করেননি। কোরআন ও হাদিসে জিহাদ বৈধ হওয়ার যে সকল শর্ত উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলির অন্যতম হলো: (১) রাষ্ট্রের অস্তিত্ব, (২) রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়া, (৩) রাষ্ট্রপ্রধানের নির্দেশ, (৪) কেবলমাত্র সশস্ত্র যোদ্ধাদের সাথে যুদ্ধ করা। ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ বইয়ে আমি এ বিষয়ক আয়াত ও হাদিসগুলি আলোচনা করেছি।
  • নিজ আচরণের মাধ্যমে উত্তম আদর্শ স্থাপন
    রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাওয়াতের অন্যতম উপকরণ ছিল নিজের জীবনে আদর্শের সর্বোত্তম বাস্তবায়নের মাধ্যমে উসওয়া হাসানাহ বা অনুকরণীয় আদর্শ স্থাপন করা। ইবাদত, বন্দেগী, আল্লাহ-ভীতি, মানব কল্যাণ, সৃষ্টির সেবা, সততা, বিশ্বস্ততা, সাহসিকতা ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন সর্বোত্তম আদর্শ। দাওয়াতের সফলতার এ হলো প্রধান উপায়।
  • উৎসাহ, পুরস্কার ও শাস্তি
    রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাওয়াতের অন্যতম প্রধান দিক ছিল উৎসাহ, পুরস্কার ও শাস্তি। তিনি প্রশংসনীয় কর্মে লিপ্ত মানুষদেরকে সুন্দর উপাধি, প্রশংসা, সম্মান, পুরস্কার ইত্যাদির মাধ্যমে উৎসাহিত করেছেন। অপরদিকে অন্যায়ে লিপ্ত মানুষদের শাস্তি প্রদান, কর্মের নিন্দা ইত্যাদির মাধ্যমে নিরুৎসাহিত করেছেন। সমাজে সৎ ও কল্যাণমুখি মানুষেরা যদি তাদের মূল্যায়ন না পান বা সততার কারণে তাঁরা যদি বঞ্চিত ও অবহেলিত হন এবং অসৎ মানুষেরা গলাবাজি বা অসততার মাধ্যমে পুরস্কৃত হন তাহলে আমাদের মুখের কথা সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না। মুখের আদেশ নিষেধ ও দাওয়াতের ন্যায় এ ধরনের প্রশংসা, সম্মান বা উৎসাহও দাওয়াতের অন্যতম মাসনূন পদ্ধতি। প্রত্যেককেই নিজের ক্ষমতা ও দায়িত্ব অনুসারে এ দিকে লক্ষ্য রাখা উচিত। দাওয়াতের জন্য এগুলি অন্যতম মাসনুন বা সুন্নাত সম্মত উপকরণ। দাওয়াত-রত মুমিনের দায়িত্ব হলো যথাসম্ভব মাসনূন উপকরণের সুন্নাত সম্মত ব্যবহারের মাধ্যমে দাওয়াতের ইবাদত পালন করা।

মাসনূন উপকরণের নিষিদ্ধ ব্যবহার

উল্লেখ্য যে, দাওয়াতের ক্ষেত্রে উপরের মাসনূন উপকরণগুলি অনেক সময় ইসলাম নিষিদ্ধ পদ্ধতিতে ব্যবহার করা হয়। আবেগ বা অজ্ঞতার ফলে দায়ী হয়ত ভাবেন যে, তিনি ইবাদত করছেন বা সাওয়াবের কাজ করছেন। অথচ তিনি মূলত পাপে লিপ্ত রয়েছেন।

ওহী-বহির্ভূত কথাকে ওহীর নামে চালনো
আমরা দেখেছি যে, ইসলামি দাওয়াত মূলত ওহী নির্ভর। আর এক্ষেত্রে ভয়ঙ্করতম অন্যায় হলো ওহীর নামে, অর্থাৎ আল্লাহ বা তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামে মিথ্যা বলা। মিথ্যা সর্বাবস্থাতেই কঠিন পাপ। আর ওহীর নামে মিথ্যা ভয়ঙ্করতম পাপ। দাওয়াতে রত মুমিন বিভিন্নভাবে এ কঠিন পাপে লিপ্ত হতে পারেন:

ওহীর নামে মিথ্যা বলা
মানবীয় কথাকে ওহীর নামে চালানোর প্রধান পদ্ধতি হলো আল্লাহ বা তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা বলেননি তা তাদের নামে বলা বা তাঁদের নামে কথিত মিথ্যা বা সন্দেহজনক কথা প্রচার করা।

দাওয়াত যেহেতু ওহী নির্ভর সেহেতু দাওয়াতরত ব্যক্তি চান যে, তার দাওয়াতের পক্ষে ওহীর বাণী শুনাবেন। ওহীর কোনো বাণী না পেলে কেউ কেউ শয়তানের প্ররোচনায় মনগড়া বানোয়াট কথাকে আল্লাহ বা তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা বলে প্রচার করেন। ইসলামের প্রথম যুগ থেকে মিথ্যা ও বানোয়াট হাদিসের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে, মানুষদেরকে ভাল পথে ডাকা ও খারাপ থেকে বিরত রাখার উদ্দেশ্যেই অধিকাংশ জাল হাদিস তৈরী ও প্রচার করা হয়েছে। বিভিন্ন নেক কাজের ফজিলত ও বিভিন্ন পাপের শাস্তির বর্ণনায় অগণিত বানোয়াট কথা জালিয়াতি করে হাদিস বলে চালানোর চেষ্টা করা হয়েছে, মুহাদ্দিসগণ তুলনামূলক নিরীক্ষার মাধ্যমে যে সকল জালিয়াতি উদঘাটন ও চিহ্নিত করেছেন।

শয়তান এ সকল জালিয়াতকে বুঝিয়েছে যে, ভাল পথে ডাকার জন্য কোরআন ও সহিহ হাদিস যথেষ্ট নয়। কাজেই ভাল উদ্দেশ্যে তুমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামে মিথ্যা বলতে পার। বর্তমান যুগেও দাওয়াতের ক্ষেত্রে মিথ্যা, অনির্ভরযোগ্য ও দুর্বল হাদিসের ছড়াছড়ি অত্যন্ত বেদনার সাথে লক্ষণীয়। কোন হাদিসে কত বেশি ফজিলত, সাওয়াব বা শাস্তির কথা বলা আছে, অথবা কোন হাদিসে কত আকর্ষণীয় গল্প আছে সেটাই শুধু লক্ষ্য করেন অনেক দায়ী। কোন হাদিসের সনদ কতটুকু শক্তিশালী তা বিবেচনা করতে তারা আগ্রহী নন। এঁরা হয়ত ভাবেন, শুধু কোরআনের আয়াত ও সহিহ হাদিস দিয়ে বোধহয় মানুষকে আকৃষ্ট করা সম্ভব নয়! আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন। যুগে যুগে এ প্রবণতা পূর্ববর্তী উম্মতদেরকে ধ্বংস করেছে। কোরআন ও হাদিসে অত্যন্ত কঠিনভাবে এ প্রবণতাকে নিষেধ করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন:

আল্লাহর নামে বা আল্লাহর সম্পর্কে যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা বলে তার চেয়ে বড় জালিম আর কে? (আনআম : ২১, ৯৩, ১৪৪, আরাফ : ৩৭, ইউনুস : ১৭, হূদ : ১৮, আল কাহফ : ১৫, আনকাবুত : ৬৮, সাফফ : ৭)

কোরআন কারীমে একাধিক স্থানে না জেনে, আন্দাজে বা অনুমান নির্ভর করে আল্লাহ, আল্লাহর দীন, বিধান ইত্যাদি সম্পর্কে কোনো কথা বলতে নিষেধ করা হয়েছে। সূরা আরাফের ৩৩ আয়াতে এরশাদ করা হয়েছে:

বল, আমার প্রতিপালক নিষিদ্ধ করেছেন প্রকাশ্য ও গোপন অশ্লীলতা আর পাপ এবং অসংগত বিরোধিতা এবং কোনো কিছুকে আল্লাহর শরিক করা যার কোন সনদ তিনি প্রেরণ করেননি, এবং আল্লাহর সম্বন্ধে এমন কিছু বলা যে সম্বন্ধে তোমাদের কোনো জ্ঞান নেই।

সূরা বাকারার ১৬৮-১৬৯ আয়াতেও অনুরূপ এরশাদ করা হয়েছে।
আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

তোমরা আমার নামে মিথ্যা বলবে না; কারণ যে ব্যক্তি আমার নামে মিথ্যা বলবে তাকে জাহান্নামে যেতে হবে। (বুখারি ও মুসলিম)।

সালামাহ ইবনুল আকওয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

আমি যা বলিনি তা যে আমার নামে বলবে তার আবাসস্থল হবে জাহান্নাম। ( সহিহ বুখারি)

আশারায়ে মুবাশশারাহ-সহ প্রায় ১০০ জন সাহাবি এ অর্থে বিভিন্ন হাদিস রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন, সকল হাদিসের অর্থ একই, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা বলেননি তার নামে ইচ্ছায়, অনিচ্ছায় বা আন্দাজ অনুমান করে বলা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এবং এর শাস্তি জাহান্নাম।

কোনো হাদিসের নির্ভুলতার বিষয়ে সন্দেহ হলে তা হাদিস হিসেবে গ্রহণ করাও নিষিদ্ধ। যদি কেউ যাচাই না করে যা শুনে তাই হাদিস বলে গ্রহণ করে ও বর্ণনা করে তাহলে হাদিস যাচাইয়ে তার অবহেলার জন্য সে হাদিসের নামে মিথ্যা বলার পাপে পাপী হবে। উপরন্ত, যদি কোনো হাদিসের নির্ভুলতা সম্পর্কে সন্দেহ থাকা সত্ত্বেও কোনো ব্যক্তি সে হাদিস বর্ণনা করে তাহলে সেও মিথ্যা হাদিস বলার পাপে পাপী হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

একজন মানুষের পাপী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শুনবে তাই বর্ণনা করবে। ( সহিহ মুসলিম )

অন্য হাদিসে তিনি বলেন,

যে ব্যক্তি আমার নামে কোনো হাদিস বলবে এবং তার মনে সন্দেহ হবে যে, হাদিসটি মিথ্যা হতে পারে, সেও একজন মিথ্যাবাদী। ( সহিহ মুসলিম)

দাওয়াতে রত মুমিনগণকে এ বিষয়ে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে। আমি যদি আজীবন একটি হাদিসও না বলি বা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামে কিছুই না বলি তাহলে হয়ত আমার কোনো গোনাহ হবে না। কিন্তু আমি দাওয়াতের কাজ করতে যেয়ে যদি কোনো মিথ্যা বা সন্দেহজনক হাদিস রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নামে বলে ফেলি তাহলে হয়ত আমাকে মিথ্যাবাদীরূপে কিয়ামতের দিন উঠতে হতে পারে। এর চেয়ে লাঞ্ছনা আর কি হতে পারে!

অনেক দায়ী যা শুনেন বা পড়েন তাই হাদিসরূপে বলেন। আমরা দেখলাম যে, হাদিসের নামে মিথ্যাচারের জন্য এটাই যথেষ্ট। কোনো হাদিস গ্রন্থে হাদিস পড়লেও তার বিশুদ্ধতা সম্পর্কে নিশ্চত না হয়ে তা বলা উচিত নয়। বড়জোর বলা যায় যে, অমুক গ্রন্থে হাদিসটি আছে, এর সনদের বিষয় আমি ভাল জানি না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, বা হাদিসে আছে এ কথাটি উচ্চারণের পূর্বে মুমিনের উচিত শতবার চিন্তা করা।

অধিকাংশ হাদিস গ্রন্থের সংকলকগণের উদ্দেশ্য ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামে কথিত বা প্রচারিত শুদ্ধ ও অশুদ্ধ সকল হাদিস সনদ সহকারে সংকলন করা, যেন মানুষেরা সনদের আলোকে তা বিচার করে গ্রহণ করতে পারে। কিছু সংখ্যক মুহাদ্দিস ঢালাও সংকলন না করে শুধুমাত্র বিশুদ্ধ হাদিস সংকলন করার চেষ্টা করেন। বুখারি ও মুসলিমের সকল হাদিস সহিহ বলে প্রমাণিত হয়েছে। তিরমিজি, আবু দাউদ ও নাসাঈ সংকলিত অধিকাংশ হাদিস সহিহ বা হাসান। তবে এগুলিতে অনেক দুর্বল হাদিসও রয়েছে, যেগুলির দুর্বলতার কথা সংকলকগণ নিজেরাই উল্লেখ করেছেন। অন্যান্য হাদিসগ্রন্থগুলিতে সহিহ, জয়ীফ, মাউযু সকল প্রকারের হাদিস সংকলিত করা হয়েছে।
আমরা অনেক সময় ভাবি যে, অমুক বুজুর্গ হাদিসটি লিখেছেন, তিনি কি বিচার না করেই লিখেছেন?! এ চিন্তা ঠিক নয়। কোনো বুজুর্গ যদি তাঁর গ্রন্থে কোনো হাদিস লিখে হাদিসটি সহিহ বলে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন তাহলে তার রিফারেণ্সে হাদিসটি বলা যেতে পারে। নইলে শুধুমাত্র কোনো গ্রন্থে আছে বলেই কোনো হাদিস বলবেন না। হাদিসটি কোন হাদিস গ্রন্থে সংকলিত এবং হাদিসটির সনদ সহিহ বা গ্রহণযোগ্য কিনা সে বিষয়ে মোটামুটি নিশ্চত না হওয়া পর্যন্ত কোনো হাদিস বর্ণনা না করাই মুমিনের জন্য নিরাপদ। কিয়ামতের দিন আল্লাহর দরবারে আমাদের প্রত্যেককেই নিজ কর্মের হিসাব নিজেই দিতে হবে।

ফজিলতের ক্ষেত্রে জয়িফ হাদিসের উপর আমল করা যায় বলে প্রচলিত একটি কথা আমাদেরকে অনেক সময় বিভ্রান্ত করে। জয়িফ হাদিসের উপর আমল করা আর জয়িফ হাদিসকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কথা বলে প্রচার করা এক নয়। অনেক আলেম কতকগুলি শর্ত সাপেক্ষ ফজিলতের ক্ষেত্রে জয়িফ হাদিসের উপর আমল করা জায়েয বলেছেন। শর্তগুলির মধ্যে রয়েছে:

  • (১). জয়িফ হাদিসটি খুব বেশি জয়িফ বা দুর্বল হবে না।
  • (২). জয়িফ হাদিসটিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কথা বলে মনে নিশ্চিত করা যাবে না। সাবধানতামূলকভাবে আমল করতে হবে। অর্থাৎ মনে করতে হবে, হাদিসটি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা হতেও পারে, কাজেই পারলে আমল করি।

অন্য অনেক আলেম জয়িফ হাদিসের উপর আমল করতে নিষেধ করেছেন। যেখানে অসংখ্য সহিহ হাদিসে নির্দেশিত কর্ম করার সময়ই অধিকাংশ মুসলিম পান না, সেখানে এ সকল জয়িফ হাদিস বিবেচনা করা ঠিক নয়। এছাড়া তারা বলেন যে, যারা জয়িফ হাদিসের উপর আমল করা জায়েয বলেছেন তাঁরা শর্ত করেছেন যে, বিশ্বাস বা আকিদাগত বিষয়ে কখনোই জয়িফ হাদিসের উপর নির্ভর করা যাবে না, শুধুমাত্র কর্মের ক্ষেত্রে সাবধানতামূলক কর্ম করা যাবে। কিন্তু বাস্তব অবস্থা হলো বিশ্বাস ও কর্ম বিচ্ছিন্ন করা মুশকিল। কারণ জয়িফ হাদিসের উপর আমল করছেন তিনি অন্তত বিশ্বাস করছেন যে, এই আমলের জন্য এই ধরণের সাওয়াব পাওয়া যেতে পারে। এজন্য এঁদের মতে জয়িফ হাদিস রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কথা নয় বলেই বিবেচিত, তার পিছনে শ্রম ব্যয় অর্থহীন। সর্বাবস্থায় সকল আলিম ও মুসলিম উম্মাহ একমত যে, মওযু বা বানোয়াট হাদিস বর্ণনা করা বা তার উপর আমল করা একেবারেই নিষিদ্ধ ও হারাম।

ব্যাখ্যাকে ওহীর সাথে সংযুক্ত করা

ওহীর নামে মিথ্যা বলার আর একটা পদ্ধতি হচ্ছে, আল্লাহ বা তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা বলেছেন তার তাফসির বা ব্যাখ্যাকে ওহীর অংশ বানিয়ে দেওয়া, যাতে শ্রোতা বা পাঠকের কাছে মনে হয়, ব্যাখ্যাও বোধহয় আল্লাহ বা তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা।

ওহী আল্লাহর বাণী। আর তাফসির বা ব্যাখ্যা মানুষের কথা। কোনো ব্যাখ্যাই ওহী নয়। কাজেই ব্যাখ্যাকে ওহী থেকে পৃথক রাখতে হবে। এছাড়া ওহীর ব্যাখ্যা অবশ্যই সুন্নাতের আলোকে করতে হবে। নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী করলে তা অপব্যাখ্যায় পরিণত হবে। দাওয়াতে রত অনেক মুমিন ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় এ অন্যায়ের মধ্যে নিপতিত হন। কোরআন হাদিসের বাণীগুলির তরজমা করার সময় আমরা আমাদের পদ্ধতির আলোকে এমনভাবে অনুবাদ করি যেন বাণীটি আমাদের পদ্ধতিই সমর্থন করছে। যেমন জিহাদ বা কিতাল ফী সাবিলিল্লাহ বিষয়ক আয়াতগুলি আমরা আমাদের পছন্দমত আত্মশুদ্ধির চেষ্টা, আন্দোলন বা দাওয়াত অর্থে অনুবাদ করি। আমাদের উচিত অনুবাদ ও ব্যাখ্যাকে সর্বদা পৃথক রাখা।

অনুবাদের ক্ষেত্রে সংযোজন বা বিয়োজন

ওহীর নামে মিথ্যা বলার তৃতীয় পদ্ধতি হলো, অনুবাদের ক্ষেত্রে শাব্দিক অনুবাদ না করে অনুবাদের সাথে নিজের মনমত কিছু সংযোগ করা বা কিছু বাদ দিয়ে অনুবাদ করা। যেমন আমরা বলি, কোরআনে আছে , আদম যখন গন্দম ফল ভক্ষণ করলেন…. এখানে গন্দম ফল কথাটি অতিরিক্ত যা কোরআনে বা হাদিসে কোথাও নেই। অনুরূপভাবে আমরা বলি, কোরআনে আছে, যখন জুলাইখা ইউসুফকে আ. বললেন…. (যুলাইখা) নামটি আমাদের কথা, কোরআনের কথা নয়। অনুবাদের সময় নিজের পছন্দ অনুযায়ী কিছু বাদ দেওয়াও একই পর্যায়ের অপরাধ।

আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী সর্বাবস্থায় আক্ষরিকভাবে উপস্থাপন করতে হবে। এরপর আমাদের ব্যাখ্যা, শিক্ষা ইত্যাদিকে পৃথকভাবে উপস্থাপিত করতে হবে।

দ্বীনের নামে অনুমান নির্ভর মতামত বা ফতওয়া দেওয়া

ওহীর নামে মিথ্যা বলার চতুর্থ পদ্ধতি হলো, আল্লাহ বা তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত না হয়ে আন্দাজ-অনুমানের উপর কিছু বলা। অধিকাংশ সময় আমরা আন্দাজেই বলি, এ ঠিক নয়, এ ইসলামে থাকতে পারে না, এ জায়েয হতে পারে না ইত্যাদি। আমরা অনেক সময় এক দুইটি আয়াত বা হাদিসের উপর নির্ভর করেই বলে ফেলি, অমুক বিষয় হারাম, বা অমুক বিষয় ইসলামে নেই। এ বিষয়ে আমাদের সতর্ক হতে হবে। আমরা যতটুকু জানি ততটুকুই বলব নইলে বলব, এ বিষয়ে স্পষ্ট কিছু জানি না।

গল্প নির্ভর ওয়াজ

আমরা দেখেছি যে, দাওয়াতের একটি মাসনূন উপকরণ হলো ওয়াজ । ওয়াজ অবশ্যই কোরআন ও হাদিস নির্ভর হবে। ওয়াজের নামে মিথ্যা হাদিস, বানোয়াট গল্প বা পূরবর্তী যুগের বুজুর্গগণের নামে প্রচারিত অনির্ভরযোগ্য বা সনদবিহিন কাহিনী বলার অগণিত ক্ষতির একটি হলো, কোরআন, হাদিস, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবিগণ থেকে মুসলিম উম্মাহকে দূরে সরিয়ে দেওয়া।

ঝগড়া নির্ভর বিতর্ক

দাওয়াতের জন্য, বিভিন্ন দাওয়াত কেন্দ্রিক দলের মধ্যে বা দাওয়াত বিরোধীদের সাথে আলোচনা বা বিতর্কের নামে ঝগড়া, বহস, বিদ্বেষমূলক বির্তক, হিংসা বা ঘৃণা প্রচার ইত্যাদি কঠিন হারাম কর্ম যেন না ঘটতে পারে সে দিকে দাওয়াতরত মানুষদের সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। এখানে কয়েকটি বিষয় গুরুত্বের সাথে মনে রাখতে হবে।

  • প্রথমত, সূরা আনকাবুতের ৪৬ আয়াতে আল্লাহ আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন যে, আহলে কিতাব বা ইহুদি-নাসরাদের সাথেও উত্তম ভাবে ছাড়া বিতর্ক না করতে। তাহলে মুসলিমদের সাথে বিতর্কের আদব কেমন হতে পারে?
  • দ্বিতীয়ত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন হাদিসে বারংবার বিতর্ক পরিত্যাগ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। এ গ্রন্থেও আমরা এ অর্থে একাধিক হাদিস দেখেছি। যে ব্যক্তি নিজের মত সঠিক জেনেও বিতর্ক পরিত্যাগ করবে আল্লাহ তার জন্য জান্নাতে বাড়ি বানিয়ে রাখবেন বলে তিনি বলেছেন। অন্যান্য হাদিসে দীন নিয়ে ঝগড়া বিতর্ক বিভ্রান্তির কারণ বলে তিনি জানিয়েছেন।
  • তৃতীয়ত, বহস বা ঝগড়া মানুষের সত্য গ্রহণের পথে বড় বাধা। বিতর্কের ক্ষেত্রে উভয় পক্ষ একটি মত গ্রহণ করে সে পক্ষে বিতর্ক করেন। বিতর্কে হেরে গেলেও তারা তা মানতে চান না; কারণ বিষয়টি অহংবোধ ও মর্যাদার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে যায়। মুমিনদের দায়িত্ব হলো খোলা মনের আলোচনার মাধ্যমে সঠিক বিষয় জানার চেষ্টা করা। তা সম্ভব না হলে বিতর্ক এড়িয়ে নিজের কাজ করা ও ভিন্নমতাবলম্বিদের জন্য দোয়া করা আমাদের দায়িত্ব।

হিকমতের নামে অবৈধ কর্ম

হিকমত-এর নামে ইসলামে নিষিদ্ধ কোনো মাধ্যম ব্যবহার করা যায় না। কোনো মহৎ উদ্দেশ্যে কোনো পাপ, অন্যায় বা নিষিদ্ধ কর্ম করা ইসলামে বৈধ নয়। মিথ্যা বলা, মদপান করা, ধোঁকা দেওয়া ইত্যাদি নিষিদ্ধ কর্মকে হিকমত বলে দাওয়াতের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার বৈধ নয়।

জিহাদ বা কিতালের নামে মারামারি বা হত্যা

জিহাদ-কিতালের নামে মারামারি বা হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত হওয়া বা আইন ও বিচার নিজেদের হাতে তুলে নেওয়া দাওয়াতের ক্ষেত্রে একটি মারাত্মক বিভ্রান্তি। কোরআন-হাদিসে যেমন বিভিন্ন ইবাদতের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তেমনি ইবাদতের জন্য শর্তবলী উল্লেখ করা হয়েছে। অগণিত স্থানে নামাজের নির্দেশ দেওয়ার পশাপাশি দু-একটি স্থানে কিবলা, পবিত্রতা, সতর, সময়, নিয়ত ইত্যাদি শর্তের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কেউ যদি এ সকল শর্ত অবজ্ঞা করে ইচ্ছামত নামাজ পড়তে থাকেন তাহলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না।
জিহাদ কিতালের ক্ষেত্রেও তেমনি অগণিত স্থানে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। পাশাপাশি কোথাও কোথাও জিহাদের জন্য রাষ্ট্র, রাষ্ট্র প্রধান, রাষ্ট্রীয় ঘোষণা, সন্ধি, আত্মসমর্পণ বা জিযিয়ার সুযোগ প্রদান ইত্যাদি শর্তের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এ সকল শর্তের বাইরে জিহাদ করলে তা ইবাদত হবে না, বরং ইসলাম বিরোধী কর্ম বলে গণ্য হবে।
রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ব্যক্তিগতভাবে বা গোষ্ঠীগতভাবে কারো বিরুদ্ধে মারামারি, খুনাখুনি, বিচার বা শাস্তি কখনোই জিহাদ নয়। এগুলি ইসলাম নিষিদ্ধ ফাসাদ, ফিতনা, সন্ত্রাস, হত্যা ও মানুষের ক্ষতি ছাড়া কিছুই নয়। কাজেই অমুক ব্যক্তি ইসলামের বিরোধিতা করছে, দাওয়াতের বিরোধিতা করছে বা ইসলাম বিরোধী কথা বলেছে কাজেই সে ইসলামের শত্রু এবং তাকে শাস্তি দিতে হবে বা তার বিরুদ্ধে জিহাদের বিধান প্রয়োগ করতে হবে এই আবেগপ্রসূত চিন্তা মুমিনকে বিভ্রান্তি ও সার্বিক ধ্বংসের মধ্যে নিপতিত করবে। এ বিষয়ে ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ গ্রন্থটি পড়তে পাঠককে অনুরোধ করছি।

দাওয়াতের আধুনিক উপকরণ

মিডিয়া, মিছিল, হরতাল ইত্যাদি আধুনিক উপকরণ

দাওয়াতের জন্য যে সকল আধুনিক উপকরণ ব্যবহার করা হয় বা করা যায় সেগুলির অন্যতম হলো কোরআন সুন্নাহ, ওয়াজ, ন্যায়ের উৎসাহ, অন্যায়ের আপত্তি ইত্যাদির জন্য পত্র-পত্রিকা, রেডিও, টেলিভিশন, ওয়েবসাইট ও অন্যান্য আধুনিক উপকরণ ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া ব্যবহার এবং মিছিল, হরতাল, ধর্মঘাট, মানববন্ধন, নির্বাচন ইত্যাদি উপকরণ ব্যবহার করা।

আধুনিক উপকরণ ব্যবহারের শর্তাবলী

এ সকল উপকরণের ক্ষেত্রে নিম্নের বিষয়গুলি লক্ষণীয়:

  • প্রথমত, এ উপকলণগুলি ইসলামের বিধি-বিধানের পরিপন্থী না হলে তা প্রয়োজন ও সুযোগমত ব্যবহার করা যাবে। তবে সেগুলিকে কখনোই দ্বীনের বা ইবাদতের অংশ মনে করা যাবে না। কেউ সেগুলি ব্যবহার না করলে তাকে নিন্দা করা বা তার দাওয়াতের ইবাদত পালনে ত্রুটি হচ্ছে বলে মনে করার অবকাশ নেই।
  • দ্বিতীয়ত, প্রয়োজন অনুসারেই তা ব্যবহার করতে হবে। এ সকল উপকরণের ব্যবহারে অমুসলিম সম্প্রদায়ের অন্ধ অনুকরণ অবশ্যই বর্জনীয়।
  • তৃতীয়ত, এ সকল উপকরণের ব্যবহারের ক্ষেত্রেও ইসলামি আখলাকের পূর্ণ উপস্থিতি আবশ্যকীয়। আন্তরিকতা, ভালবাসা, বিনম্রতা, বন্ধুভাবপন্নতা, উৎকৃষ্ট দিয়ে মন্দ প্রতিরোধ ইত্যাদি বিষয় সকল অবস্থায় পালনীয়। গীবত, ঢালাও অভিযোগ ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রেই বর্জনীয়। অনেক সময় আমরা ওয়াজ, দাওয়াত, তাফসির, খুতবা ইত্যাদির সময় ইসলামি আখলাকের অনুসরণ করি। পক্ষান্তরে নির্বাচন, জনসভা, মিছিল ইত্যদির সময়ে পাশ্চাত্য রীতির অনুসরণ করি। এগুলিতে আমরা কাফির-ফাসিকদের মত জ্বালাও পোড়াও, ভেঙ্গে ফেল, গুড়িয়ে দাও ইত্যাদি ভাষা ব্যবহার, চিৎকার, লাফালাফি, গালাগালি, হাতে তালি ইত্যাদি ইসলাম নিষিদ্ধ কর্ম করে থাকি। মনে হয় এগুলিতে ইসলাম পালনের প্রয়োজন নেই বা এগুলি ইসলামি কায়দায় করা যায় না। কাফির-ফাসিকদের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও মুমিনের দাওয়াত ও দ্বীন প্রতিষ্ঠা কখনোই একই আখলাকের হতে পারে না।

হরতাল, ধর্মঘট, অবরোধ, কুশপুত্তলিকা

আধুনিক উপকরণগুলি অবশ্যই ইসলামি বিধি-বিধানের আওতায় ব্যবহার করতে হবে। দাওয়াত, আদেশ, নিষেধ বা প্রতিবাদের নামে ইসলাম নিষিদ্ধ কোনো কাজ করা যায় না। হরতাল, ধর্মঘট, অবরোধ এ জাতীয় একটি আধুনিক উপকরণ, যা পাশ্চাত্য জগত থেকে আমাদের মধ্যে প্রবেশ করেছে এবং অনেক সময় পাশ্চাত্যের অনুকরণে ইসলাম বিরোধীভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

যদি কোনো সমাজে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে নাগরিকদের মতামত প্রকাশের জন্য মিছিল, হরতাল ইত্যাদির প্রচলন ও স্বীকৃতি থাকে তাহলে সে সমাজের দায়ীগণ দাওয়াতের বা আদেশ নিষেধের জন্য হয়ত তা ব্যবহার করতে পারেন, তবে তা অবশ্যই স্বতস্ফূর্ত ও ঐচ্ছিক হলে। হরতাল, ধর্মঘট, অবরোধ, প্রতিবাদসভা ইত্যাদির নামে রাস্তাঘাট বন্ধ করা, কাউকে কষ্ট দেওয়া, জোরপূর্বক অংশগ্রহণ করানো, জানমালের ক্ষতি করা, কর্মস্থলের অধিকার নষ্ট করা ইত্যাদি সবই কঠিন হারাম কর্ম। অনুরূপভাবে মুর্তি, কুশপুত্তলিকা বা কার্টুনমুর্তি তৈরী করা, ফাঁসি দেওয়া, পোড়ানো ইত্যাদিও ইসলাম নিষিদ্ধ কর্ম। এগুলি পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ ছাড়া কিছুই নয়। পাশ্চাত্য রীতি অনুসারে হরতালের সময় কর্মচারী ও কর্মকর্তাগণ কাজ বন্ধ করে দেন। ইসলামের নির্দেশে কর্মচারী বা কর্মকর্তার সাথে চুক্তি মোতাবেক পরিপূর্ণ সময় কর্ম করতে বাধ্য। তিনি তাঁর চুক্তি বাতিল করতে পারেন, কিন্তু চুক্তিবদ্ধ থাকা অবস্থায় চুক্তি ভঙ্গ করতে পারেন না। তাহলে জুলুম ও মানুষের হক নষ্ট করার পাপে পতিত হবেন। তিনি তার কর্মদাতার অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারেন। কিন্তু পাপের মাধ্যমে নয়। কর্মদাতার অন্যায়ের ক্ষেত্রেও তিনি কর্ম না করে টাকা নিতে পারেন না। আইনানুগ পদ্ধতিতে অন্যায়ের প্রতিকার করতে পারেন। তাহলে যেক্ষেত্রে কর্মদাতার কোনো অন্যায় নেই, রাষ্ট্রের বা অন্য কারো অন্যায়ের প্রতিবাদ তিনি চুক্তির খেলাফ করে কাজ না করে বসে থাকবেন কিভাবে?

এছাড়া এ জাতীয় কর্ম অনেক সময় উম্মতের জন্য ক্ষতিকর। আমেরিকা বা ইসরাইলের কোনো একটি অন্যায়ের প্রতিবাদে বাংলাদেশের মানুষ একদিন হরতাল-ধর্মঘট পালন করলে ইহুদিদের কোনো ক্ষতি হবে না। ক্ষতি হবে বাংলাদেশের, রাষ্ট্রের ও জনগণের। এরূপ কর্ম কখনোই শরিয়তে বৈধ হতে পারে না এবং কোনো অবস্থাতে ন্যায় প্রতিষ্ঠার বা অন্যায়ের প্রতিবাদের ইসলামি মাধ্যম হতে পারে না। বিশ্বের যে কোনো স্থানে মজলুম মানুষ ও প্রাণীর প্রতি সমবেদনা ও জুলুমের নিন্দা করা মুমিনের দায়িত্ব। তবে তা ইসলামি আখলাক ও পদ্ধতির আওতায় করতে হবে। গণমাধ্যমের ব্যবহার, শান্তিপূর্ণ সমাবেশ, জালিমের কাছে প্রতিবাদ পাঠানো, মজলুমের সাহায্যে এগিয়ে যাওয়া ইত্যাদি অনেক পদ্ধতি রয়েছে যা ইসলাম সম্মত।

পাশ্চাত্য ষ্টাইলে জাগতিক ক্ষমতার দ্বন্দ্বে লিপ্ত মানুষেরা স্বভাবতই হালাল হারামের তোয়াক্কা করবে না। কিন্তু দাওয়াত ও দীন প্রতিষ্ঠার কর্মে লিপ্ত মুমিনকে অবশ্যই আল্লাহর নির্দেশ, বান্দার হক্ক ইত্যাদির বিষয় গুরুত্বের সাথে লক্ষ্য রাখতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, আমাদের প্রতিটি কাজের জন্য একদিন আল্লাহর দরবারে চুলচেরা হিসাব দিতে হবে। এ দুনিয়ার সামাজিক জীবনে এ সকল হক্ক নষ্ট করা হয়ত আমরা খুবই হালকাভাবে দেখি, কারণ, কোনো অন্যায় সবত্র ঘটতে দেখলে তা গা সওয়া হয়ে যায়। কিন্তু আল্লাহর হিসাবে আমরা পার হতে পারব কি?

উপকরণ বনাম ইবাদত : বিভিন্ন ভুলভ্রান্তি

প্রাচীন যুগ থেকেই মুসলিম উম্মাহর মধ্যে দাওয়াত বা দীন প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব পালনের জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি, দল ও মতের সৃষ্টি হয়েছে। এগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কল্যাণকর ও প্রয়োজনীয়। প্রত্যেকেই কোরআন ও হাদিস থেকে নিজেদের কর্মের অনুপ্রেরণা গ্রহণ করেছেন। পাশাপাশি যুগ ও পরিবেশের চাহিদা মুতাবেক কিছু নতুন পদ্ধতি সংযোজন করেছেন। সাধারণভাবে এ সকল পদ্ধতি ইবাদত হিসেবে চালু করা হয়নি। ইবাদত পালনের সহায়ক উপকরণ হিসাবেই এগুলিকে চালু করা হয়েছে। কিন্তু কালের আবর্তনের সাথে সাথে এ সকল পদ্ধতির অনুসারীরা এসকল পদ্ধতিকে ইবাদতের অংশ বলে মনে করে বিভ্রান্তি ও দলাদলির মধ্যে নিপতিত হয়েছেন।

এ সকল নব উদ্ভাবিত দল বা পদ্ধতির ক্ষেত্রে দুইটি বিষয় লক্ষণীয়:

  • প্রথমত, মাসনূন উপকরণগুলি প্রয়োজন অনুসারে খেলাফে সুন্নতভাবে সীমিত করা বা নির্ধারিত করা। যেমন কোরআন. হাদিস, ওয়াজ ইত্যাদির মাধ্যমে দাওয়াত প্রদানের জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো সিলেবাস-পাঠ্যক্রম, সময়, স্থান বা পদ্ধতি নির্ধারণ করে দেননি। এ সকল উদ্ভাবিত পদ্ধতিতে প্রয়োজন অনুসারে তা নির্ধারিত করা হয়েছে। নির্ধারিত গ্রন্থাবলী পড়ার বা নির্ধারিত দিন, মাস বা বছর ধরে বা নির্ধারিত সময়ে বা স্থানে দাওয়াতি কর্ম করার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
  • দ্বিতীয়ত, এগুলির মধ্যে প্রয়োজন অনুসারে খলাফে সুন্নত বা সুন্নত বহির্ভূত নতুন কিছু উপকরণ বা পদ্ধতি সংযুক্ত করা হয়েছে।

অনেক সময় এ প্রকারের সংযোজন বা নির্ধারণের জন্য কোরআন হাদিস থেকে অনুপ্রেরণা নেওয়া হয়। যেমন আল্লাহ রমজানে একমাস রোজা পালনের নির্দেশ দিয়েছেন, কাজেই আমরা আমাদের দাওয়াতের কোর্স একমাস নির্ধারণ করেছি। এর মধ্যে বিশেষ বরকত পাওয়া যাবে। অথবা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দশ দিন ইতিকাফ করতেন, এজন্য আমরা আমাদের ওয়াজ মাহফিল দশদিন ব্যাপি করেছি। অথবা তিনি হিজরত করে চিরস্থায়ীভাবে মক্কা শরিফ ত্যাগ করে মদিনায় গমন করেছিলেন, এজন্য আমরা দাওয়াত, ওয়াজ বা দীন প্রতিষ্ঠার জন্য এক দেশের মানুষকে হিজরত করে অন্য দেশে স্থায়ী বসবাসের ব্যাবস্থা করি। অথবা তিনি হজ্জের সময় ইহরামের কাপড় পরিধান করতেন, এজন্য আমরা দায়ীদেরকে দাওয়াতের সময় ইহরামের কাপড় পরিধান করার ব্যবস্থা করেছি।

এ প্রকারের অনুপ্রেরণার ভাল দিক থাকলেও অনেক সময় বিদআত ও সুন্নত বিরোধিতার জন্ম দেয়। যেমন, নামাজ আদায়ের জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাঁড়াতে নির্দেশ দিয়েছেন বা উৎসাহ দিয়েছেন। কিন্তু কোরআন তিলাওয়াতের জন্য তিনি এরূপ কোনো নির্দেশ বা উৎসাহ দেননি। তিলাওয়াতের ইবাদত তিনি উন্মুক্তভাবে পালন করেছেন। বসে বা দাঁড়িয়ে যে কোনো অবস্থায় তিলাওয়াত করলে সমান সাওয়াব পাওয়া যাবে। এখন যদি কেউ মনে করেন যে, নামাজের জন্য দাঁড়ানো ফরজ বা উত্তম অতএব তিলাওয়াতও দাঁড়িয়ে করা উত্তম বা দাঁড়িয়ে তিলাওয়াত করলে অতিরিক্ত সাওয়াব বা বরকত পাওয়া যাবে, তবে তিনি খেলাফে সুন্নত একটি কর্মকে ইবাদতের অংশ মনে করে বিদআত ও সুন্নাত বিরোধিতায় লিপ্ত হলেন।

আমি এহইয়াউস সুনান গ্রন্থে সুন্নত থেকে বিদআতে উত্তরণের বিভিন্ন কারণ ও পদ্ধতির আলোচনা করেছি। গ্রন্থটির পঞ্চম অধ্যায়ের পঞ্চম পদ্ধতির আলোচনায় উপকরণকে ইবাদত মনে করার বিভিন্ন প্রবণতা বিস্তারিত আলোচনা করেছি। আমি পাঠককে আবারো সবিনয় অনুরোধ করছি বইটি পড়তে। এখানে শুধুমাত্র একটি বিষয়ের প্রতি পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। বর্তমান সময়ে অনেক নেককার মুমিন দাওয়াতের কাজে রত রয়েছেন। সকলেরই উদ্দেশ্য আল্লাহর পথে দাওয়াতের মাধ্যমে সমাজের সর্বত্র ইসলামকে প্রতিপালিত ও প্রতিষ্ঠিত করা। এ সকল কাজের মধ্যে পার্থক্য:

  • প্রথমত, নাম ও পরিভাষা ব্যবহারে। তাজকিয়া, আন্দোলন, ইকামতে দীন, তাবলীগ, জিহাদ, মাদ্রাসা, ওয়াজ ইত্যাদি বিভিন্ন নাম ব্যবহার করা হচ্ছে।
  • দ্বিতীয়ত, দাওয়াতের বিষয়বস্তু নির্ধারণে। ঈমান-আকিদা , শিক্ষা, আত্মশুদ্ধি, ব্যক্তিগত কর্ম, সমাজ সেবা, রাজনৈতিক পরিবর্তন ইত্যাদি একেক দল একেক বিষয়কে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন।
  • তৃতীয়ত, পদ্ধতিতে। বিভিন্ন দল বিভিন্ন পদ্ধতিতে কাজ করছেন। পদ্ধতিগুলি কোনোটিই হুবহু মাসনূন পদ্ধতি নয়।

এ সকল পদ্ধতিতে দাওয়াত ও দীন প্রতিষ্ঠায় রত অনেকেই এ সকল খেলাফে সুন্নাত বা সুন্নাত বহির্ভূত পদ্ধতি ও উপকরণকে মূল ইবাদত দাওয়াত এর অংশ মনে করছেন এবং বিভিন্ন বিভ্রান্তির মধ্যে নিপতিত হচ্ছন।

  • প্রথমত, একে অন্যের দাওয়াতের ইবাদত পালিত হচ্ছে না বলে মনে করছেন। কেউ হয়ত ওয়াজ, গ্রন্থ রচনা, মাদ্রাসা ইত্যাদি মাধ্যমে দাওয়াতের দায়িত্ব পালন করছেন, কিন্তু অন্য পদ্ধতির দায়ী ভাবছেন, যেহেতু তিনি আমার পদ্ধতিতে কাজ করছেন না, সেহেতু তার দাওয়াতের ইবাদত পালিত হচ্ছে না।
  • দ্বিতীয়ত, অনেক সময় একে অন্যের কোনো ইবাদতই হচ্ছে না বলে মনে করছেন। যেহেতু ঐ ব্যক্তির দাওয়াত বা দীন প্রতিষ্ঠা নামক ইবাদত পালিত হচ্ছে না, সেহেতু তার অন্য কোনো ফরজ, সুন্নাত ও নফল ইবাদত কবুল হচ্ছে না। কাজেই আমার পদ্ধতির বাইরে যারা রয়েছেন তাদের নামাজ, রোজা, হ্জ্জ, জিকির, তিলাওয়াত, তাহাজ্জুদ ইত্যাদি সবই মূল্যহীন বা অপূর্ণ।

এ সকল বিভ্রান্তির অন্যতম কারণ হলো নব উদ্ভাবিত খেলাফে সুন্নত উপকরণ বা পদ্ধতিকে মূল ইবাদতের অংশ মনে করা। আমাদের উচিত পদ্ধতির চেয়ে মূল ইবাদতের দিকে বেশি লক্ষ্য রাখা, নিজের ইবাদত কবুল হচ্ছে কিনা সেদিকে বেশি লক্ষ্য রাখা এবং সকল মুসলিম ও সকল দায়ীকে আল্লাহর ওয়াস্তে ভালবাসা।

সবচেয়ে দু:খজনক হলো এ সকল কারণে দলদলির জন্ম নেওয়া। কোরআন ও হাদিসে উম্মাহর মধ্যে ইফতিরাক বা দলাদলি কঠিনভাবে নিষেধ করা হয়েছে। কোরআন সুন্নাহর আলোকে ইসলামি আকিদা গ্রন্থে আমি এ বিষয়ক আয়াত ও হাদিস বিস্তারিত আলোচনা করেছি। ইসলামে মতভেদ থাকতে পারে কিন্তু দলভেদ থাকতে পারে না। বস্তুত আমাদের একটিই দল আছে, তার নাম ইসলাম । সকল মুসলিম আল্লাহর দল এবং সকল কাফির শয়তানের দল। শয়তানের দলকে মুমিন অন্য দল বলে মনে করেন। কোনো মুসলিমকে অন্য মুসলিম অন্য দল বলে মনে করতে পারেন না। পদ্ধতিগত বা মতামতগত পার্থক্যের কারণে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে দলাদলি ও বিভক্তি নি:সন্দেহে অত্যন্ত বেদনাদায়ক বিষয়।
শেষ কথা

সম্মানিত পাঠক, দাওয়াতের পূর্ণতা, কবুলিয়্যাত ও সফলতার জন্য দায়ী-মুবাল্লিগদের পারস্পরিক সম্প্রীতি, মহব্বত ও ঐক্য প্রয়োজন। মহান আল্লাহ আমাদেরকে দীন প্রতিষ্ঠা করতে এবং দলাদলি-মতভেদ না করতে নির্দেশ দিলেন। কিন্তু আমরা দলদলি মতভেদে লিপ্ত রয়েছি। আমরা সকলেই ঐক্যের কথা বলছি। কিন্তু ঐক্য হচ্ছে না কেন?
অনেক কারণ থাকতে পারে। একটি কারণ হলো, আমরা প্রত্যেকেই নিজের দায়িত্বের চেয়ে অন্যের দায়িত্বের কথা বেশি চিন্তা করছি। প্রত্যেকেই মনে করছি, এ বিভক্তি বা বিচ্ছিন্নতার জন্য আমি বা আমার দল দায়ী নয়, বরং অমুক বা তমুক দায়ী। তবে প্রকৃত কথা হলো আমরা সকলেই কমবেশি অপরাধী। আমাদের প্রয়োজন, নিজের দায়িত্বের দিকে বেশি লক্ষ্য রাখা। অন্যেরা আমার বিরুদ্ধে যাই করুক, আমি সকল দায়ীকে ভালবাসব, সবাইকে আমার আন্দোলনের কর্মী ও আমার কাফেলার সাথী বলে মনে করব। সম্ভব হলে তাদের ভুলত্রুটি ভালবেসে সংশোধনের চেষ্টা করব। নইলে আল্লাহর কাছে তাদের সংশোধনের দোয়া করব। নিজের দায়িত্ব পালনে আমি সচেষ্ট থাকব।

ঐক্য বলতে সকল দায়ী একই মাদ্রাসায় পড়াবেন বা একই পদ্ধতিতে দাওয়াত দিবেন বলে আমরা আশা করতে পারি না। একই শহরে কোরআন শিক্ষার বিভিন্ন কারিকুলাম ও পদ্ধতির অনেকগুলি মাদ্রাসা থকতে পারে। সবারই উদ্দেশ্য কোরআন শিক্ষা। তবে পদ্ধতির ত্রুটি ও শিক্ষকদের আমলের ত্রুটি থাকতে পারে। তা সত্বেও সকলের মধ্যে মহব্বত ও একই কাফেলার সহযাত্রী-র অনুভূতি থাকা প্রয়োজন। সম্ভব হলে পরস্পরে ভুলত্রুটি ভালবেসে সংশোধন করার চেষ্টা করতে হবে। না হলে কোরআনের খাদেম হিসাবে ত্রুটিসহই ভালবাসতে হবে। না হলে প্রত্যেকে নিজের মত কাজ করতে হবে। কিন্তু যদি সকল মাদ্রাসার ছাত্র শিক্ষকগণ সর্বদা পরস্পরের পদ্ধতি ও কর্মের দোষত্রুটির সন্ধান, আবিস্কার ও প্রচারে ব্যস্ত থাকেন তাহলে কি কোরআনের খিদমত ভালভাবে হবে?

মহান আল্লাহ দয়া করে দাওয়াতের ময়দানে কর্মরত সকলের ভুলত্রুটি ক্ষমা করুন, তাঁদের প্রচেষ্টা কবুল করুন এবং সর্বোত্তম পুরুস্কার প্রদান করুন। দাওয়াত বিষয়ক এই ক্ষুদ্র আলোচনার এখানেই ইতি টানছি। এর মধ্যে যদি কোনো কল্যাণকর কিছু থাকে তবে তা আমার করুণাময় প্রতিপালক আল্লাহ জাল্লা জালালুহুর একান্ত দয়া। আর এর মধ্যে ভুলভ্রান্তি যা আছে তা সবই আমার নিজের দুর্বলতা ও শয়তানের প্রবঞ্চনার কারণে। আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। সকল প্রসংশাই তাঁর। সালাত ও সালাম তাঁর প্রিয়তম হাবিব ও খলিল মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর পরিজন, সহচর ও অনুসারীগণের উপর।

সমাপ্ত

5 comments on “আল্লাহর পথে দাওয়াত – সুন্নাতের আলোকে দাওয়াত: ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর – ৫

  1. পিংব্যাকঃ আল্লাহর পথে দাওয়াত – দাওয়াতের ক্ষেত্রে ভুলভ্রান্তি: ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর – ৪ | In Search of Inner Peace | ইস

  2. পিংব্যাকঃ আল্লাহর পথে দাওয়াত -দাওয়াতের শর্ত ও দায়ীর গুণাবলী: ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর -৩ | In Search of Inner Peace | ইসলামিক

  3. পিংব্যাকঃ আল্লাহর পথে দাওয়াত : পুরস্কার ও শাস্তি- ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর -২ | In Search of Inner Peace | ইসলামিক বাংলা ব্লগ

  4. পিংব্যাকঃ আল্লাহর পথে দাওয়াত : ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর -১ | In Search of Inner Peace | ইসলামিক বাংলা ব্লগ

  5. পিংব্যাকঃ আল্লাহর পথে দাওয়াত : ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর -১ | In Search of Inner Peace | ইসলামিক বাংলা ব্লগ

মন্তব্য করুন